বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮ পূর্বাহ্ন
চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি, কালের খবর :
যশোরের চৌগাছা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের অস্তিত্ব দিনদিন বিলীন হতে চলেছে। নদটি বোবা কান্নায় কাঁদছে।
এক শ্রেণির অসাধু ভূমিদস্যুর ছোবলে ভয়ংকরভাবে নদটি অস্তিত্বসংকটে পড়েছে। চোখের সামনে প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা নদটির বুকে ফেললেও রহস্যজনক কারণে ওই সব ভূমিদস্যু ও অসাধুদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। রয়েছে স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক জটিলতাও। ফলে নদটি দিন দিন সংকুচিত হয়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কপোতাক্ষ নদের তীরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর শৈশব কাটিয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সে থাকা অবস্থায় শৈশবের কথা স্মরণ করে ‘কপোতাক্ষ নদ’ নামে চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করেন। সেই কপোতাক্ষ নদ এখন অস্তিত্বসংকটে। কপোতাক্ষ নদ ভৈরব নদীর একটি শাখা। দ্রাবিড়পূর্ব জনগোষ্ঠীর ‘কবদাক’ সংস্কৃত ভাষা থেকে কপোতাক্ষ শব্দে রূপান্তরিত হয়।
ইছামতী নদী কুষ্টিয়া জেলার দর্শনার কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি শাখা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত, যা ভৈরব নদ নামে পরিচিত। কোটচাঁদপুরের দক্ষিণে ভৈরব থেকে একটি শাখা বের হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে খুলনা জেলার পাইকগাছার কাছে শিবসা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভৈরবের এ শাখাই কালপরিক্রমায় কপোতাক্ষ। এ নদীর পানি কপোত বা পাখির অক্ষির (চোখ) মতো স্বচ্ছ ছিল বলে নদীটির নাম হয় কপোতাক্ষ। তবে প্রকৃতপক্ষে, কপোতাক্ষের উৎপত্তি মাথাভাঙ্গা নদী থেকে। একসময় এ নদটি ৭৫০ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত ছিল। নদের দৈর্ঘ্য ছিল ২৬০ কিলোমিটার।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কোটচাঁদপুর উপজেলা থেকে তাহেরপুর দিয়ে কপোতাক্ষ নদটি উপজেলায় প্রবেশ করে তা সীমান্ত দিয়ে বা কখনো বিভিন্ন গ্রামের মধ্য দিয়ে ছুটিপুর পর্যন্ত চেৌগাছা সীমানায় বিস্তৃত নদটি। উপজেলার নদের বিস্তৃত রয়েছে ২৩ কিলোমিটার।
নারায়ণপুর, হাজরাখানা, চৌগাছা ব্রিজসংলগ্ন, ধুলিয়ানী, কাবিলপুর, কংশারীপুর এলাকায় গেলে এলাকাবাসী জানান, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের এক সময়কার প্রমত্তা কপোতাক্ষ নদ ছিল এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র আশা ভরসা। জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস ছিল কপোতাক্ষ নদ। এ নদ দিয়ে নৌকাযোগে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হতো। নদসংলগ্ন গ্রাম এলাকার হাজারো মানুষ কপোতাক্ষ নদ থেকে মৎস্য আহরণ করে জীবন চালাতেন। কিন্তু এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি কপোতাক্ষ নদ এখন কালের বিবর্তনে মৃতপ্রায়।
দেখা গেছে, ভূমিদস্যুরা নদের জমি দখল করে কপোতাক্ষ নদ গ্রাস করে ফেলেছে। কোনো স্থানে তৈরি করা হয়েছে উঁচু প্রাচীর, অবৈধ স্থাপনা। অনেক স্থানে নদের মধ্যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে নদের বুকে পাটাতন ও কিছু জায়গায় নদকে অবৈধভাবে দখল করে বসবাসের স্থান তৈরি করা হয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়তই নদের জমি দখলের প্রতিযোগিতা চলছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নারায়ণপুর, পেটভরা, টেঙ্গুরপুর, চৌগাছা, কংশারিপুর, দিঘলসিংহা, মাশিলা, কদমতলা, কাবিলপুর, খলশিসহ অনেক স্থানে নদের জমি দখল করা হয়েছে। এমনও দেখা গেছে নদের মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে পুকুর। চৌগাছা বাজারের ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় নদের জমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে আবাসন ও বহুতল ভবন। অনেকে রংপুরসহ ভিন্ন জেলা থেকে এসে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় নদ দখল করে বস্তি তৈরি করে বসবাস করছে। বর্তমানে নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়ছে। নদের বুকে নেই স্রোতধারা। যেটুকু পানি আছে তাতে বুঝার উপায় নেই এটি একটি নদ। কোনো কোনো স্থানে হাঁটু সমান পানিও নেই। চৌগাছা বাজারের ব্রিজসংলগ্ন নদের বুকে ময়লা-আবর্জনার শতশত স্তূপ লক্ষ করা গেছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যা হলেই বাজারের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা কপোতাক্ষ নদের বুকে ফেলে যান। বিশেষ করে মুরগি ব্যবসায়ী, কসাই ও সবজি ব্যবসায়ীরা প্রতিনয়তই ময়লা ফেলেন। সন্ধ্যার পর ব্রিজ ও ব্রিজের আশপাশে ময়লা ফেলার হিড়িক পড়ে যায়। প্রকাশ্যে নদের বুকে ময়লা ফেলা হলেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে টন টন ময়লা-আবর্জনায় দুর্বিষহ অবস্থায় নদটি ধুকেধুকে মরছে।
নদী গবেষক এম মুজাহিদ আলী জানান, কপোতাক্ষ নদটি ১২০ কিলোমিটার খনন করলে ফিরে পাবে তার নবযৌবন। এর ফলে নদ অববাহিকায় গড়ে উঠবে শিল্পকারখানার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ নদটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
নদপাড়ের কৃষক আবদার রহমান খোকন বলেন, একসময় প্রমত্তা কপোতাক্ষ নদ থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে কৃষি ফসলি জমিতে সেচ দিতাম। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। ফলে নদ এলাকায় সবজি চাষ করা সম্ভব হয় না। গভীর নলকূপ থেকে সেচ দেওয়া হলেও সেচের পানি কিনতে হয় চড়ামূল্যে। তা ছাড়া গভীর নলকূপের পানির চেয়ে কপোতাক্ষ নদের পানি জমির জন্য বেশি উপকারী। কেননা এই পানিতে জৈব সারের কাজ করে।
এ বিষয়ে পৌর মেয়র নূর উদ্দিন আল মামুন হিমেল বলেন, কপোতাক্ষ নদকে আমরা যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করছি এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে তারানিবাস মৌজায় এলাকায় ১ একর ২৩ শতক জমি ক্রয় করা হয়েছে। পৌরবাসী সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে পারবে। এর পরেও পৌরবাসী যদি কপোতাক্ষ নদে ময়লা-আবর্জনা ফেলেন তাহলে প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবৈধভাবে নদ দখল ও ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা দ্রুত কপোতাক্ষ নদকে দখলমুক্ত করব। এরই মধ্যে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। দখলকারীর তালিকা আমরা করছি। যারা ময়লা-আবর্জনা ফেলছে তাদের তালিকা সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। দ্রুতই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।